Header Ads

Header ADS

পথকলিরা ডাস্টবিনের খাবার কুঁড়াচ্ছে, আকাশে হাজার হাজার টাকার পতাকা উড়ছে

এক. রাফির স্কুল ছুটি হয়েছে এইমাত্র। সে এখন রিক্সায় করে সরাসরি তাদের মহল্লার আর্জেন্টাইন ফ্যানস ক্লাবে চলে গেলো। সেখানে মিটিং হচ্ছে বড় পর্দায় খেলা দেখা আর পতাকা বানানো নিয়ে। রাফি ক্লাবে ঢুকা মাত্রই তার বন্ধু রনি তাকে বলল, - কিরে রাফি, খবর কিছু জানিস? - নাতো, কি হয়েছে বল। - ব্রাজিলের সাপোর্টারসরা এইবার ৩০০ মিটার লম্বা পতাকা বানাচ্ছে - বলিস কি! রাফি বিস্ময়ভরা চোখে জিজ্ঞেস করল। রনি বলল, 'আমরা বড় পর্দায় খেলা দেখার জন্য প্রত্যেকের উপর ৫০০ টাকা চাঁদা ফেলেছি। আর ৫০০ মি. লম্বা পতাকা বানাব। এই এলাকার সবচেয়ে বড় পতাকা। তোর উপর তিন হাজার টাকা চাঁদা পড়ছে।পর্দারটা সহ মোট সাড়ে তিন হাজার টাকা, বুঝলি?' দোস্ত এত টাকা.... 'হয়েছে, থাম' রনি রাফিকে কথাটা শেষ করতে দিলনা। সে কড়া ভাষায় বলল, "যদি না পারিস তাহলে এখানে বড় পর্দায় খেলা দেখতে আসিস না, আর আমাদের সাথে চলাফেরাও করিস না।" দুই. "বাবা, আমাদের মহল্লায় আমরাই সবচেয়ে বড় পতাকা বানাচ্ছি। সেই সাথে আমরা বড় পর্দায় খেলা দেখারও আয়োজন করছি। বাবা, সাড়ে তিন হাজার টাকা লাগবে আমার" রাফি বুকে অনেক আশা নিয়ে তার বাবার কাছে আবদার করল। টাকার পরিমাণ শোনে রাফির বাবা থ বনে গেলেন। সে ছোট খাটো একটা চাকরী করেন। ষোল হাজার টাকার বেতনের। তারমধ্যে ঘর ভাড়া আছে ৭ হাজার টাকা। আছে ছেলে মেয়ের পড়ালেখারর খরচ। তার উপর ঈদের কেনাকাটা তো আছেই। এই সামান্য বেতনে কোন রকমে তার সংসারটাই মাত্র চলে। সঞ্চয়ের কোন উপায় নেই। রাফির বাবা তাকে নরম স্বরে বলল, - বাবা এত টাকা তোমায় কিভাবে দিব! সামনে তোমাদের জন্য ঈদের নতুন জামাকাপড় কিনতে হবে না...! - আমার কোন কাপড়চোপড় কিনতে হবে না বাবা, আমার শুধু টাকাটাই চাই। এই কথা শোনামাত্রই রাফির বাবা তেলেবেগুনে গরম হয়ে গেলো। সোফা থেকে উঠে গেলেন চট করে। রুম থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন আর উঁচু গলায় চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছেন, "পারবনা এত টাকা দিতে, লেখাপড়া তো করেই না, কয়েকদিন পরপর, এটা লাগবে, ওঠা লাগবে। যেন সব মগেরমুল্লুক পাইছে" না, কথাটা মোটেই সত্য নয়। রাফি অনেক ভালো করেই লেখাপড়া করে। আর সে বিশেষ প্রয়োজন ছাড়া কোন কিছু চাইও না। "এই! টাকাটা দিয়েই দাও না, দেখেছ ছেলেটা কেমন জেদ ধরেছে। আবার না জানি কি করে বসে। ওর এই আবদারটা না হয় মিটিয়ে দাও।" রাফির মা রাফির বাবাকে খুবি নরম গলায় অনুরোধ করল। রাফির বাবা কোন জবাব দিলেন না। সে বেলকনিতে এসে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নীল আকাশের পানে তাকিয়ে আছেন নির্লিপ্ত দৃষ্টিতে। আর মাঝে মাঝে ফেলছেন দীর্ঘশ্বাস। যেন গভীর কোন চিন্তায় সে মগ্ন হয়ে পড়েছে। তিন. রাফি এই মাত্র নামাজ পড়ে আসল। সে কোন রোজা ভাঙছে না। রমজান মাস আসার পর থেকে তার এক ওয়াক্ত নামাজও ছুটেনি। মাঝে মধ্যে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত করতেও দেখা যায় তাকে। রাফির বাবা তাকে প্রাণভরে ভালবাসেন। আর রমজান মাসে ছেলের এমন ইবাদতে সে এত্ত খুশি হল যে তার ইচ্ছা করে কলিজাটা ছিঁড়ে দিয়ে হলেও ছেলেকে সে স্বর্গসুখের নীড় এনে দিবে। "রাফি, রাফি, এই রাফি এখানে একটু আস তো" রাফির বাবা রাফিকে উচ্চ কন্ঠে ডাকলেন।" - জ্বি বাবা। - বাবা, তোমার কি টাকাটা লাগবেই..? - হু - একটু কম দিলে কি হবে, বাবা? রাফি মাথা নাড়ল না সূচক ভঙ্গিতে। আর করুণ চোখে তার বাবার দিকে তাকালো। "আচ্ছা বাবা আচ্ছা। এই নাও তোমাকে পুরো টাকাটাই দিলাম, এবার খুশি তো, হ্যাঁ...?" টাকা পেয়ে রাফি আনন্দে আত্মহারা। সাথে সাথেই সে চলে গেলো রনির হাতে টাকাটা দেয়ার উদ্দেশে। চার. রাফি রনির হাতে ৩৫০০ টাকা বুঝিয়ে দিয়ে বাড়ি ফিরছে অত্যন্ত খুশি মনে। সে ভাবতেই পারছে না তারাই এলাকার সবচেয়ে বড় পতাকাটা বানাবে। আর সবার সাথে একসাথে খেলা দেখা হবে বড় পর্দায়। ওহ! কত যে আনন্দ হবে। রাফি মনে মনে নিয়ত করল সে আজ তার বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করবে। ঈদ ছাড়া সে কোনোদিন তারা বাবা মায়ের পা ছুঁয়ে সালাম করেনি। আজ তো তার কাছে ঈদ ঈদই লাগছে। তার মনে ঈদের মতোই আনন্দধারা বহিছে। কিন্তু আচমকা তার সেই আনন্দে ভাটা পড়ে একটি দৃশ্য দেখে। ছোট্ট একটা শিশু। গায়ে ময়লাযুক্ত বিশ্রী একটা ছেড়া কাপড়। সে করুণ চোখে কাঁদো কাঁদো কন্ঠে এক ভদ্র লোকের কাছে টাকা চাচ্ছিল। "যা ভাগ এইখান থেকে" দয়া পাওয়ার বদলে, টাকা পাওয়ার বদলে সে ধমক খেল। দেখে বুঝা যাচ্ছে ধমক খেয়ে শিশুটা কোন কষ্ট পেল না। যেন তার কাছে প্রতিদিনকার মতোই একটি স্বাভাবিক ঘটনা এটি। শিশুটার একটু সামনেই একটা ডাস্টবিন। সে এক দৌড়ে ডাস্টবিনে যায়। অতঃপর সেখান থেকে কুঁড়িয়ে কুঁড়িয়ে খাবার খায়। এতক্ষণ ধরে এই দৃশ্যটাই দেখছিল রাফি। শিশুটি ডাস্টবিনের খাবার খেয়ে এবার রাফির দিকে এগিয়ে এসে টাকা চাইল। রাফি তার নাম জিজ্ঞেস করল, - তোমার নাম কি? - বজলু - পলিথিনে ডাস্টবিন থেকে খাবার ভরেছ কেন? - ছোডো বইন মারুফার লাইগ্যা। - তোমার বাবা মা আছেন? - বাপ নাই। মা আছে। আগে ভিক্ষা কইরা আমারে আর মারুফারে খাওয়াইত। অহন কি রোগ জানি হয়ছে। দিন রাইত খালি ঘুমায়। খাওন দাওনও ছাইড়া দিছে। ডাক্তারের কাছে গেছিল। কিন্তু রোগ ভাল হয়ছেনা এইবার আর চোখের পানি ধরে রাখতে পারল না রাফি। তার হৃদয়ে যেন রক্তক্ষরণ হচ্ছে। যে শিশুটা এখন বিদ্যালয়ে পড়ার কথা। পরিবার পরিজন নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার অর্ধেক বয়সও যার হয়নি সেই কিনা তার ছোট বোনের জন্য মানুষের দ্বারে দ্বারে ভিখ মাগছে। আহারে জীবন!! ভাবতেই রাফির শরীর মনে শিহরণ জেগে উঠল। পাঁচ. সে শিশুটাকে একটা জায়গায় দাঁড় করিয়ে দৌড়ে রনির কাছে গেল। সে রনিকে তার টাকাটা ফিরিয়ে দিতে বলল। বলল সে তার টাকাটা পরে দিবে। তাতে রনি রাজি না হলে সে অনেক অনুরোধ করে টাকাটা ফিরিয়ে আনে এবং শিশুটাকে ছুলা মুড়ি সহ বিভিন্ন ইফতার সামগ্রী কিনে দেয়। শিশুটার শরীরে মারাত্মক দুর্গন্ধ। মনে হয় অনেক দিন ধরে সাবান দিয়ে গোসল করে না। তাই শিশুটাকে সে একটা সাবানও কিনে দিল। আর বলল, "সাবান দিয়ে ভালো করে গোসল করবে, ঠিক আছে" "আইচ্ছা" শিশুটা বলল। শিশুটির মুখে এবার স্বর্গীয় হাসির দেখা মিলল। শিশুটা চলে যাচ্ছে। রাফি অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখছে। শিশুটা একটু দূরে গেলে রাফি পেছন দিকে ফেরে তার বাসায় যাওয়ার জন্য। যেই পেছন ফিরল সেইমাত্র সে কাঠ হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো। রাফির সামনে তার বাবা। পুরো দৃশ্যটাই সে দেখেছে। রাফি এবার নিজেকে কোনভাবেইই সামলাতে পারল না। সে এক দৌড়ে গিয়ে তার বাবার পা ছুঁয়ে সালাম করল। রাফির বাবা অনুভব করল তার পা ভিজে গেছে তার ছেলের চোখের নোনা পানিতে। রাফির বাবা রাফিকে বুকে টেনে নিল। তার বাবাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে কিন্তু কান্নার কারণে সে বলতে পারছে না। তার বাবা তাকে বুকে জড়িয়ে বলছে, "শাবাশ! বাবা আমার, শাবাশ" ..............

No comments

Powered by Blogger.